পরিচ্ছেদ ১৬.৫ : জঙ্গিবাদ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার | NCTB BOOK

জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদের ধারণা
জঙ্গি শব্দটি ইংরেজি ‘Militant' এবং ল্যাটিন শব্দ 'মিলিট্যার' (Militare) থেকে এসেছে। 'মিলিট্যার' শব্দের অর্থ হলো সৈনিক হিসেবে কাজ করা। আচরণিক দৃষ্টিকোণ থেকে জঙ্গি বলতে তাদের বোঝায় যারা যুদ্ধবাজ, আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক এবং ধ্বংসকারী। জঙ্গিরা আক্রমণাত্মক ও হিংসাত্মক উপায়ে রাষ্ট্র বা সমাজ অননুমোদিত সংস্কারের সমর্থনে সমবেতভাবে কাজ করে। জঙ্গিরা চরম ও হিংসাত্মক পন্থার আশ্রয় নেয়। শুধু ধংসাত্মক কাজে অংশগ্রহণকারীই নয়, এ কাজে চাঁদা প্রদান ও সংগ্রহ এবং পরিকল্পনা গ্রহণসহ সকল সহায়তাকারীও জঙ্গি হিসেবে পরিচিত। জঙ্গি কার্যক্রম এককভাবে কিংবা দলীয়ভাবেও পরিচালিত হতে পারে। জঙ্গিরা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে তাদের সংগঠন প্রণীত ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ধারণা বা দর্শন সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবর্তন করতে চায়। তাদের ধারণা প্রচারের জন্য লিফলেট, পোস্টার, পুস্তিকা প্রচারসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক প্রচার মাধ্যম, যেমন- ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি ব্যবহার করে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা সবসময়ই প্রকাশ করতে চায় তাদের ধারণাই সঠিক, তা রাষ্ট্র এবং সমাজ অনুমোদনপ্রাপ্ত হোক বা না হোক। রাষ্ট্রে বিদ্যমান আদর্শ, মূল্যবোধ, নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান তারা মানতে চায় না। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে তারা বোমা, স্থলমাইন, সামরিক অস্ত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক মারণাস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকে। আত্মঘাতের মাধ্যমেও জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কখনোবা তারা বিমান ছিনতাই করে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। জঙ্গিদের প্রস্তুত করার জন্য ব্যাপক গোপন সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে তাদের রয়েছে গোপন আস্তানা ও যোগাযোগ । রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কার্যক্রম সম্পর্কিত অননুমোদিত নীতিই জঙ্গি নীতি। জঙ্গি দ্বারা রচিত, প্রচারকৃত ও অনুসৃত ধ্যানধারণাই জঙ্গিবাদ নামে পরিচিত।

জঙ্গিবাদের কারণ
বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর চরম রাজনৈতিক কিংবা উগ্র ধর্মীয় অধিকার বা স্বার্থের কারণে গোষ্ঠী চেতনা থেকে জঙ্গি উন্মাদনার জন্ম নিতে পারে। দেশের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারে । নৈরাজ্য সৃষ্টির পিছনে কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও লুক্কায়িত থাকতে পারে। জীবন-জগৎ সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ ধারণা কিংবা ধর্মীয় অজ্ঞতার কারণেও অনেক সময় ব্যক্তি জঙ্গিতে পরিণত হতে পারে। আন্তঃগোষ্ঠী কিংবা গোষ্ঠীভিন্নতায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের দ্বন্দ্ব থেকেও জঙ্গি কর্মতৎপরতা সৃষ্টি হতে পারে।

জঙ্গিবাদের প্রভাব ও প্রতিরোধ
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে জঙ্গি কর্মতৎপরতার প্রভাব ভয়াবহ ও মারাত্মক। জঙ্গি তৎপরতার কারণে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে পারে। তাছাড়া জঙ্গি কার্যক্রম আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের কাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যেতে পারে। আমরা বিশ্বের বহু দেশের জঙ্গিদের দ্বারা সংঘটিত অনেক অপরাধকর্ম সম্পর্কে কমবেশি জানি। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কারণ এই জঙ্গিবাদ। হাজার হাজার মানুষকে হত্যাসহ বহু সম্পদ ধ্বংস হয়েছে এই জঙ্গি কর্মকাণ্ডে। মুম্বাইয়ের হোটেল তাজের হামলাও জঙ্গিদের কর্মকান্ড। আমাদের দেশে যশোর জেলায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে এবং পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে হত্যা জঙ্গিদের কাজ। সম্প্রতি ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে বেশ কিছু দেশি বিদেশি নারী ও পুরুষকে হত্যা করে। অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিরা এসব কাজে আত্মাহুতি দিয়ে থাকে। একটি দেশে অব্যাহতভাবে জঙ্গি কার্যক্রম সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য হুমকিস্বরূপ। জঙ্গি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের পরিবারের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিদের রক্ষিত বোমা বিস্ফোরণে একই সাথে বসবাসকারী মানুষ, আবাসস্থল ও প্রতিবেশীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। মূলত জঙ্গিদের কোনো সুস্থ পারিবারিক জীবন থাকে না। সমাজ এবং রাষ্ট্র এদেরকে অপরাধীর দৃষ্টিতে দেখে। অনেক সময় নিজ পরিবারও জঙ্গিদের ঘৃণার চোখে দেখে। এক্ষেত্রে পরিবারের সকলকে সন্তানের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। জঙ্গি কর্মতৎপরতার প্রতিরোধে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দ সতর্ক থাকলে জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধ সহজতর হবে। সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় ধারণার সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রচারপত্র, পোস্টার, লিফলেট প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভার মাধ্যমে উগ্র বিভ্রান্ত ধর্মদর্শনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। এককথায় সুস্থ পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন জঙ্গি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে ।

কাজ-একক: জঙ্গির বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত কর।

কাজ-দলগত: রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে জঙ্গি কর্মকান্ডের প্রভাবগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরোধ পদক্ষেপ লেখ ।

 

Content added || updated By
Promotion